বেলা আন্দাজ দুপুর বারোটা। রাজ্যের শাসক দলের এক মন্ত্রীর অফিস। মন্ত্রী নেই। তার জেলারই আরেক বিধায়কের অফিসে তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। এই মিটিংয়ের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে বেশ কিছু কন্ট্র্যাক্টচ্যুয়াল কাজের প্রার্থীদের তালিকা। হাজার হাজার প্রার্থীদের মধ্যে থেকে যোগ্য মানুষদের খুঁজে নেওয়াই এই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। যোগ্যতার যেসব মাপকাঠি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল টাকা। তাই দরদাম চলছে। ঠিক কত লাখ টাকায় ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ লিখে দেওয়া যায় তার খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা মিটিং করুক। আমরা বরং ফিরে আসি মন্ত্রীর অফিসে। মন্ত্রী নেই। তাই মন্ত্রীর চেয়ার আলো করে বসে আছেন মন্ত্রীর পতিদেব। সাথে রয়েছেন মন্ত্রীর বিশ্বস্ত পিএ। ইনি স্বামী স্ত্রী দুজনেরই অত্যন্ত অনুগত। হঠাৎ 'দাদা আসছি' বলে কেবিনে প্রবেশ করলেন পার্টির একজন বিশিষ্ট কর্মী। এই কেবিনে সবার আসার অনুমতি নেই। বেশীরভাগ পার্টি কর্মীই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেবিনের বাইরেই বসে থাকেন। দাদা বা বৌদি ডাকলে ভেতরে যান। তবে এনার ব্যপারটা আলাদা। এর হাত ধরে কেও এসেছেন অথচ চাকরি হয়নি, এমন উদাহরণ বিরল। ইনি ঠিক 'যোগ্য' চাকরিপ্রার্থীদেরই বাছাই করে নিয়ে আসেন। যারা সবদিক থেকে 'যোগ্য'। তাই মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর স্বামীর কৃপাদৃষ্টি রয়েছে এনার ওপর।
দাদা- হ্যাঁ বল, কেমন আছ? আজকাল তো দেখাই পাওয়া যায়না তোমার।
বিশিষ্ট কর্মী- আরে দাদা কি যে বলেন? এই আপনাদের আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে আর কি। আজ দাদা আমাদের এলাকার দুজন মহিলা কর্মীকে এনেছি। দারুণ কাজ করে দাদা। এলাকায় সংগঠন এদের হাত ধরে অনেক মজবুত হয়েছে। ওই আইসিডিএস না কিসে কয়েকটা চাকরি বেরিয়েছে না? তো সে খবর পেয়েই এরা আমার কাছে এসেছিল। আমি বললাম আমাকে বলে কি হবে? মাথার ওপর দাদা আছেন। ওনাকেই সরাসরি বল। আমি টাকা-পয়সার কথা সব বলে দিয়েছি দাদা। আপনি বাকি কথা বলে নিন।
দাদা- ওহ এতোদিন কাজ করছ এখনও তোমায় শেখাতে পারলাম না। এসব কথা এতো চেঁচিয়ে বলার কি আছে? বাইরে কতজন এই এক আবেদন নিয়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে জানো? কয়েকজন তো সেই নোটিস বেরোনোর দিন থেকে আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। বসো। একটু থিতু হও। এই তোমরাও বসো।
মহিলা দুজন বসলেন। এদের একজনের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। ছেলের বয়স ছয় বছর। স্বামী কাজকর্ম তেমন কিছুই করতেন না। তাই বিচ্ছেদের সময় ক্লেম করেও কোনোরকম খোরপোষ পাওয়া যায়নি। বাড়ির অবস্থা মাঝারি। তাই একটা চাকরি পাওয়ার আশায় ভিড়েছেন শাসকদলে। দ্বিতীয়জনের বাড়ির অবস্থা একেবারেই খারাপ। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। বাবা মায়ের অনেক আশা মেয়ে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। বাড়ির দুঃখ ঘোচাবে। মেয়ে জানতো চাকরির বাজারের অবস্থা তাই কলেজে পড়তে পড়তেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠন করত। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে তিন তিনটে বছর এলাকার নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে। সবশেষে আজ একটা সুযোগ এসেছে।
দাদা এবার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখো জগন্নাথ যখন তোমাদের এনেছে তখন নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।
অবিবাহিতা মেয়েটি খানিক লাজুক প্রকৃতির। সে চুপ করেই রইলো।
তুলনায় ডিভোর্সি মহিলা খানিক সাহসী। তিনি বললেন, 'দাদা, বারো হাজার টাকার কাজের জন্য পাঁচ লাখ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?'
দাদা একটু হেসে বললেন, 'আরে! তুমি বেতনটা দেখছ কেন? ওতে তো তোমায় হাতই দিতে হবেনা। ষাট বছর অবধি চাকরি করবে। দুহাতে কামাবে। উপরি যা পাবে, তাতেই তোমার চলে যাবে। আর তুমি কি ভাবছ ওই টাকা আমি একা নেব? আরও কত জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে জানো? জগন্নাথ আমাদের নিজেদের লোক। তাই তোমাদের এতো কথা বলছি। নাহলে টাকা দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। যাই হোক টাকা নিয়ে রবিবার বিকেল নাগাদ আমার বাগানবাড়িতে পৌঁছে যাবে। তারপর বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকিয়ে বললেন একসাথেই আবার দুজন চলে এসোনা যেন। এই সপ্তাহে তুমি এসো। সামনের সপ্তাহে ওকে পাঠিয়ে দিও।'
ইঙ্গিত বুঝতে পেরে দুজনের মুখ ততক্ষণে লাল হয়ে উঠেছে। ডিভোর্সি মহিলাটিই প্রথমে মুখ খুললেন, 'এ কি বলছেন দাদা? আমরা কোথাও যেতে পারব না। টাকা আমরা জগন্নাথদার হাতে দিয়ে দেব। সেরকমই তো উনি বললেন। দাদার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। জগন্নাথকে আর তুমি তুমি না করে সরাসরি তুইয়ে নেমে এলেন, 'কি রে তুই এদের বলে আনিসনি? শুধু টাকা দিলে চাকরি হয়?' জগন্নাথের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, 'না মানে স্যার লাস্ট দু'বার তো আপনি ছিলেন না। ম্যাডাম ডিল করেছিলেন, তাই ব্যপারটা মাথায় ছিল না আরকি’।
দাদা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, 'তোমরা এখন এসো। পরে কথা হবে।'
এর ঠিক বছরখানেক পরের কথা। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন পাশের গ্রামের একমাত্র ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। পেশেন্টদের লম্বা লাইন। হঠাৎ সেই লাইনে দেখতে পেলেন সেই অবিবাহিতা মেয়েটিকে, 'আরে তুমি! কতদিন পরে দেখলাম তোমায়। কেমন আছ? এখানে কেন? শরীর খারাপ নাকি? ' অবিবাহিতা মেয়েটি স্মিত হেসে বললেন, ‘এই দেখো না কাশিটা সারছেই না। তার সাথে আবার গলাব্যথা। তুমি কেমন আছ? কি করছ এখন?’
ডিভোর্সি মহিলা- এই চলে যাচ্ছে ভাই। করব আর কি? এই ছেলে মানুষ করছি। আর মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসি। তুমি কি এখনও পরীক্ষা দিচ্ছ?
অবিবাহিতা- দিচ্ছিলাম, শেষে ওই আইসিডিএস এর কাজটা পেলাম। গত মাসেই জয়েন করেছি।
ডিভোর্সি মহিলা- ওই কাজটা? কিন্তু কিভাবে? আমি তো জানতাম ওই অসভ্য ছোটোলোকটার হাত ছাড়া ওই চাকরি কোনোভাবেই হতে পারে না।
অবিবাহিতা- আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করনা, দিদি। আমি বলতে পারবনা। শুধু বলব তোমার মতো সাহস সবার থাকেনা গো। কাওকে কাওকে আপোষ করতে হয়। তবে জানোতো সেদিন ওই জানোয়ারটার অফিসে থুথু ছিটিয়ে আমিও বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সাহস ধরে রাখতে পারলাম কৈ? আমি হেরে গেলাম দিদি। তাই আমায় আপোষ করে যেতে হবে বাকিটা জীবন। চাকরিটা ছেড়ে দিলেও আমার নিস্তার নেই। তুমি ভাল আছো দিদি, ভালো থেকো।
এই অবধি বলে ডিভোর্সি মহিলাটির অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে মেয়েটা ডাক্তার না দেখিয়েই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়লো। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরলেন।