সমস্ত লেখাগুলি

টিকটিকি -
সুমন কর্মকার
Dec. 3, 2024 | গল্প | views:898 | likes:0 | share: 0 | comments:0

রামিজ মিঞা গ্রিল আর তারজালির ফাঁক দিয়ে মন দিয়ে টিকটিকিটা দেখছিল। কালো, গায়ে চৌকোনা ছোপ, সামনের দিকের বাঁ পা টা পেছন দিকে কেতরে ডান পা টায় ভর দিয়ে খানিক উঁচু হয়ে সামনের দোতলার ড্রেনপাইপটায় লেপ্টে ছিল। ভঙ্গীটা এমন যেন এগোবে কিন্তু এগোচ্ছিল না। রামিজ রোজ দেখে টিকটিকিটাকে। দেখতে দেখতে একটা অভ্যেসমতো হয়ে গিয়েছে। আজ অবধি ওটাকে একচুল নড়তে দেখেনি ও। তাই সারাদিন খেয়াল না থাকলেও দুপুর বেলার এই সময়টায় বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে পাইপটার দিকে চোখ চলেই যায়। এই সময়টায় শাকিনা রোজ ফোন দেয়। বাবুদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধোওয়ার পর শাকিনা খানিক বিশ্রামের সুযোগ পায়। তখনই রামিজের ফোন বেজে ওঠে। রামিজ বিরক্ত হয়। ও এটা ওটা বলে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে আবার মন দিয়ে টিকটিকি দেখতে থাকে। আজকাল রামিজের দিনগুলো বড় মন্থর গতিতে পেরোয়। গেলোবছর বর্ষায় কারখানার মেশিন চাপা পড়ে বাঁ হাতখানা বাদ পড়ার পর মালিক কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিয়ে দিয়েছে। শাকিনাকে লোকের বাড়িতে কাজ করতে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। প্রথম প্রথম একা একা থাকতে ভীষণ খারাপ লাগতো। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই শাকিনার ফোন রামিজের রোজকার একাকীত্বে খানিক ছন্দপতনই ঘটায়। আর ছন্দপতন আসে যেকোনো সরকারি ছুটিতে দোতলা বাড়িটা থেকে ভেসে আসা মাতালটার অশ্রাব্য চিৎকারে। গোটা বস্তিতে এই একটাই দোতলা বাড়ি। রামিজ যখন কাজে যেত শাকিনা রোজ বলত মাতালটার কথা। ছুটির দিন হলেই মাতালটা সকাল থেকে গলা অবধি মদ গিলে এসে বৌটাকে সারাদিন ধরে পেটায় আর যাচ্ছেতাই গালি গালাজ করে। তখন রামিজ তেমন পাত্তা দেয়নি। আজ বুঝতে পারে এই নিঃঝুম দুপুরবেলায় ওই মাতালটার চিৎকার কতখানি অসহ্য লাগে। এখন আবার চিৎকারের যোগ্য সঙ্গত করছে মাতালের বৌয়ের অস্পষ্ট গোঙানি। নাঃ অসহ্য লাগছে। রামিজ উঠে পড়লো। বাড়ি থেকে বেরোনোর পথে শাকিনার সেলাইয়ের কাঁচিটা তুলে নিলো। দরজার শিকল দিতে গিয়ে ড্রেন পাইপটার দিকে চোখ পড়লো ওর। সেই কুৎসিত টিকটিকিটা বেশ খানিকটা নেমে এসেছে। আর ওর মুখে একটা গোটা আরশোলা, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। চেষ্টা করছে বেরিয়ে যাওয়ার, উদ্ধার পাওয়ার। টিকটিকিটা একটুও নড়ছেনা। পরম নিশ্চিন্ত মুখ করে লেপ্টে আছে নোংরা শ্যাওলাধরা ড্রেন পাইপটায়। কালো পুঁতির মতো চোখগুলো নিশ্চল। রামিজ বাঁ হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কাঁচিখানা শক্ত করে বাগিয়ে ধরলো......

কৃপাদৃষ্টি -
সুমন কর্মকার
Nov. 23, 2024 | গল্প | views:1012 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বেলা আন্দাজ দুপুর বারোটা। রাজ্যের শাসক দলের এক মন্ত্রীর অফিস। মন্ত্রী নেই। তার জেলারই আরেক বিধায়কের অফিসে তার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে। এই মিটিংয়ের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে বেশ কিছু কন্ট্র‍্যাক্টচ্যুয়াল কাজের প্রার্থীদের তালিকা। হাজার হাজার প্রার্থীদের মধ্যে থেকে যোগ্য মানুষদের খুঁজে নেওয়াই এই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। যোগ্যতার যেসব মাপকাঠি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল টাকা। তাই দরদাম চলছে। ঠিক কত লাখ টাকায় ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ লিখে দেওয়া যায় তার খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে। ওরা মিটিং করুক। আমরা বরং ফিরে আসি মন্ত্রীর অফিসে। মন্ত্রী নেই। তাই মন্ত্রীর চেয়ার আলো করে বসে আছেন মন্ত্রীর পতিদেব। সাথে রয়েছেন মন্ত্রীর বিশ্বস্ত পিএ। ইনি স্বামী স্ত্রী দুজনেরই অত্যন্ত অনুগত। হঠাৎ 'দাদা আসছি' বলে কেবিনে প্রবেশ করলেন পার্টির একজন বিশিষ্ট কর্মী। এই কেবিনে সবার আসার অনুমতি নেই। বেশীরভাগ পার্টি কর্মীই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেবিনের বাইরেই বসে থাকেন। দাদা বা বৌদি ডাকলে ভেতরে যান। তবে এনার ব্যপারটা আলাদা। এর হাত ধরে কেও এসেছেন অথচ চাকরি হয়নি, এমন উদাহরণ বিরল। ইনি ঠিক 'যোগ্য' চাকরিপ্রার্থীদেরই বাছাই করে নিয়ে আসেন। যারা সবদিক থেকে 'যোগ্য'। তাই মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর স্বামীর কৃপাদৃষ্টি রয়েছে এনার ওপর। 

দাদা- হ্যাঁ বল, কেমন আছ? আজকাল তো দেখাই পাওয়া যায়না তোমার।

বিশিষ্ট কর্মী- আরে দাদা কি যে বলেন? এই আপনাদের আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে আর কি। আজ দাদা আমাদের এলাকার দুজন মহিলা কর্মীকে এনেছি। দারুণ কাজ করে দাদা। এলাকায় সংগঠন এদের হাত ধরে অনেক মজবুত হয়েছে। ওই আইসিডিএস না কিসে কয়েকটা চাকরি বেরিয়েছে না? তো সে খবর পেয়েই এরা আমার কাছে এসেছিল। আমি বললাম আমাকে বলে কি হবে? মাথার ওপর দাদা আছেন। ওনাকেই সরাসরি বল। আমি টাকা-পয়সার কথা সব বলে দিয়েছি দাদা। আপনি বাকি কথা বলে নিন।

দাদা- ওহ এতোদিন কাজ করছ এখনও তোমায় শেখাতে পারলাম না। এসব কথা এতো চেঁচিয়ে বলার কি আছে? বাইরে কতজন এই এক আবেদন নিয়ে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে জানো? কয়েকজন তো সেই নোটিস বেরোনোর দিন থেকে আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। বসো। একটু থিতু হও। এই তোমরাও বসো। 

মহিলা দুজন বসলেন। এদের একজনের সদ্য ডিভোর্স হয়েছে। ছেলের বয়স ছয় বছর। স্বামী কাজকর্ম তেমন কিছুই করতেন না। তাই বিচ্ছেদের সময় ক্লেম করেও কোনোরকম খোরপোষ পাওয়া যায়নি। বাড়ির অবস্থা মাঝারি। তাই একটা চাকরি পাওয়ার আশায় ভিড়েছেন শাসকদলে। দ্বিতীয়জনের বাড়ির অবস্থা একেবারেই খারাপ। বাড়ির একমাত্র মেয়ে। বাবা মায়ের অনেক আশা মেয়ে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। বাড়ির দুঃখ ঘোচাবে। মেয়ে জানতো চাকরির বাজারের অবস্থা তাই কলেজে পড়তে পড়তেই শাসক দলের ছাত্র সংগঠন করত। গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে তিন তিনটে বছর এলাকার নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে। সবশেষে আজ একটা সুযোগ এসেছে। 

দাদা এবার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখো জগন্নাথ যখন তোমাদের এনেছে তখন নতুন করে বলার আর কিছুই নেই। তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।

অবিবাহিতা মেয়েটি খানিক লাজুক প্রকৃতির। সে চুপ করেই রইলো। 

তুলনায় ডিভোর্সি মহিলা খানিক সাহসী। তিনি বললেন, 'দাদা, বারো হাজার টাকার কাজের জন্য পাঁচ লাখ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?'

দাদা একটু হেসে বললেন, 'আরে! তুমি বেতনটা দেখছ কেন? ওতে তো তোমায় হাতই দিতে হবেনা। ষাট বছর অবধি চাকরি করবে। দুহাতে কামাবে। উপরি যা পাবে, তাতেই তোমার চলে যাবে। আর তুমি কি ভাবছ ওই টাকা আমি একা নেব? আরও কত জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে জানো? জগন্নাথ আমাদের নিজেদের লোক। তাই তোমাদের এতো কথা বলছি। নাহলে টাকা দেওয়ার লোকের তো অভাব নেই। যাই হোক টাকা নিয়ে রবিবার বিকেল নাগাদ আমার বাগানবাড়িতে পৌঁছে যাবে। তারপর বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকিয়ে বললেন একসাথেই আবার দুজন চলে এসোনা যেন। এই সপ্তাহে তুমি এসো। সামনের সপ্তাহে ওকে পাঠিয়ে দিও।' 

ইঙ্গিত বুঝতে পেরে দুজনের মুখ ততক্ষণে লাল হয়ে উঠেছে। ডিভোর্সি মহিলাটিই প্রথমে মুখ খুললেন, 'এ কি বলছেন দাদা? আমরা কোথাও যেতে পারব না। টাকা আমরা জগন্নাথদার হাতে দিয়ে দেব। সেরকমই তো উনি বললেন। দাদার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। জগন্নাথকে আর তুমি তুমি না করে সরাসরি তুইয়ে নেমে এলেন, 'কি রে তুই এদের বলে আনিসনি? শুধু টাকা দিলে চাকরি হয়?' জগন্নাথের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, 'না মানে স্যার লাস্ট দু'বার তো আপনি ছিলেন না। ম্যাডাম ডিল করেছিলেন, তাই ব্যপারটা মাথায় ছিল না আরকি’।

দাদা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, 'তোমরা এখন এসো। পরে কথা হবে।' 

এর ঠিক বছরখানেক পরের কথা। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন পাশের গ্রামের একমাত্র ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। পেশেন্টদের লম্বা লাইন। হঠাৎ সেই লাইনে দেখতে পেলেন সেই অবিবাহিতা মেয়েটিকে, 'আরে তুমি! কতদিন পরে দেখলাম তোমায়। কেমন আছ? এখানে কেন? শরীর খারাপ নাকি? ' অবিবাহিতা মেয়েটি স্মিত হেসে বললেন, ‘এই দেখো না কাশিটা সারছেই না। তার সাথে আবার গলাব্যথা। তুমি কেমন আছ? কি করছ এখন?’

ডিভোর্সি মহিলা- এই চলে যাচ্ছে ভাই। করব আর কি? এই ছেলে মানুষ করছি। আর মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসি। তুমি কি এখনও পরীক্ষা দিচ্ছ?

অবিবাহিতা- দিচ্ছিলাম, শেষে ওই আইসিডিএস এর কাজটা পেলাম। গত মাসেই জয়েন করেছি।

ডিভোর্সি মহিলা- ওই কাজটা? কিন্তু কিভাবে? আমি তো জানতাম ওই অসভ্য ছোটোলোকটার হাত ছাড়া ওই চাকরি কোনোভাবেই হতে পারে না। 

অবিবাহিতা- আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করনা, দিদি। আমি বলতে পারবনা। শুধু বলব তোমার মতো সাহস সবার থাকেনা গো। কাওকে কাওকে আপোষ করতে হয়। তবে জানোতো সেদিন ওই জানোয়ারটার অফিসে থুথু ছিটিয়ে আমিও বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সাহস ধরে রাখতে পারলাম কৈ? আমি হেরে গেলাম দিদি। তাই আমায় আপোষ করে যেতে হবে বাকিটা জীবন। চাকরিটা ছেড়ে দিলেও আমার নিস্তার নেই। তুমি ভাল আছো দিদি, ভালো থেকো।

এই অবধি বলে ডিভোর্সি মহিলাটির অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে মেয়েটা ডাক্তার না দেখিয়েই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়লো। ডিভোর্সি মহিলাটি ছেলেকে আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরলেন। 

বেমানান -
সুমন কর্মকার
Nov. 21, 2024 | গল্প | views:286 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় সৌরকে দেখতে পাওয়া যায় স্টেইন্ড গ্লাস পাবের বাঁদিকের একদম কোনার টেবিলে। ও কখনোই ডান্সফ্লোরে আসে না। কার্লসবার্গের দুটো ক্যান আর চারটে ক্লাসিক ওর কোটা। কখনোই এর কম-বেশি হয়না। নিজের চেয়ারে বসে নৃত্যরত মানুষগুলোকে দেখা, ওদের দিক থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথা, হাসির শব্দ শুনতে ওর বেশ লাগে। আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে একটা ঝিমুনি অনুভূত হয়। তারপর কোটা পূরণ হয়ে গেলেই বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের একলা ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। এভাবেই এক শনিবারের সন্ধ্যেয় সৌর দেখতে পেল একদল প্রাণোচ্ছল যুবক-যুবতীকে। দলে আছে তিনটে ছেলে আর দুটো মেয়ে। দেখেই বোঝা আছে দুটো কাপল গ্রুপ আর তাদেরই এক বন্ধু। হাই সাউন্ডের মাঝে একে অন্যের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে কিছু কথা বলছে আর মাঝেমাঝে হেসে উঠছে। ওরা পাঁচটে চেয়ারের একটা টেবিলে বসে বিয়ার অর্ডার করল। এই অবধি দেখে সৌর টেবিল ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম গেল। ফিরে এসে দেখল এর মধ্যেই গ্রুপটা ডান্সফ্লোরে চলে গিয়েছে এবং গোল হয়ে ঘিরে চলছে নাচ। রোজকার চিত্র। নতুন কিছু নয়। সৌর নিজের কোটা পূরণে মনোনিবেশ করল। কোটা যখন প্রায় শেষের মুখে হঠাৎ একটা গোলমালের আওয়াজ সৌরর দৃষ্টি আকর্ষন করল। একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ডিজে গান থামিয়ে দিয়েছে। বাউন্সাররা নিজেদের কর্তব্যপালনে নেমে পড়েছে। সৌর উঠে পড়ল। জায়গাটায় যেয়ে যা বুঝল, ওই পাঁচজনের গ্রুপের একটি মেয়েকে নাচতে নাচতে অন্য একটি যুবক নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল, সাথে সাথেই মেয়েটি যুবকটিকে একটি সপাটে চড় মেরেছে। তাতেই তৈরি হয়েছে এই বিপত্তি। যুবকটি এই গ্রুপের কারোরই পরিচিত নয়। 

লম্বায় প্রায় ছফুট, ফর্সা গালটাতে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে, এলকোহলের প্রভাবে চোখদুটো খানিক রক্তাভ।

পাশে আস্তিন গুটিয়ে রাগী-রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি খুব সম্ভবত যুবতীটির বয়ফ্রেন্ড। গ্রুপের বাকিদের মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে তারাও অসভ্য ছেলেটাকে একহাত বুঝে নিতে চায় কিন্তু বাউন্সারদের জন্য সেই সুযোগ পাচ্ছে না। একটু পরেই একজন বাউন্সার ছেলেটাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলার সাথে সাথেই ছেলেটা মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল। ওর থমথমে মুখটা দেখে সৌরর বেশ ভালোই লাগলো। ঠিক হয়েছে। নেশাগ্রস্ত মেয়ের সুযোগ নিতে যাওয়ার যোগ্য জবাব পেয়েছে। ভাবলো মেয়েটাকে একটু সাবাসি দিয়ে আসবে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো ওদের দলটাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ছে। এইধরণের উটকো ঝামেলার পর নাচের আগ্রহ হারানোটা স্বাভাবিক। সৌরও নিজের টেবিলে ফিরে এলো। অর্ধেকটা বিয়ার এখনো পড়ে আছে। গরম হয়ে গিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে সৌর বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। 

এরপরের শনিবার পাবে ঢুকতে সৌরর খানিক দেরিই হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়েই বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে বেরোয়নি। ক্যাব অবধি আসতে আসতেই অল্প ভিজে গেল। এই সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের জায়গায় জায়গায় জল জমে গেছে। স্টেইন্ড গ্লাস ওর অফিস থেকে ক্যাবে পঞ্চাশ মিনিটের রাস্তা। আজ জ্যামের জন্য সেই রাস্তাই পেরোতে সময় লাগলো এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পাবে ঢুকেই ও ওর কোনার টেবিলে চলে এলো। রেগুলার কাস্টমার। তাই আলাদা করে অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। ওয়েটার ক্যানগুলো আনতে আনতে সৌর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো। ডিজে হাল্কা সাউন্ডে একটা রোমান্টিক গান বাজাচ্ছে। কাপলরা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে জড়িয়ে নাচ করছে। সিঙ্গেলরা কেও কেও নিজেদের টেবিলে বসে লালায়িত দৃষ্টিতে দৃশ্যটা উপভোগ করছে, আবার কেও কেও বিরক্তি প্রকাশ করছে ডিজের ওপর। হঠাৎ একটা কাপলের ওপর সৌরর চোখ আটকে গেল। আরে! এ তো সেই সাহসী মেয়েটাই। আগের দিন অসভ্যতা করার জন্য যে চড় মেরেছিল। আশেপাশে ওদের গ্রুপের আর কেও চোখে পড়ল না যদিও। সাথে নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটার খালি পেছন দিকটাই দেখা যাচ্ছে। বেশ লম্বা। ব্ল্যাক গ্লসি শার্টের সাথে ডেনিম জিন্স। এই তো ওরা ঘুরছে। ধীরে ধীরে ছেলেটার মুখটা সৌরর দৃষ্টিগোচর হলো। আর সাথে সাথেই ও চমকে উঠলো। এটা তো সেই চড় খাওয়া ছেলেটাই। ছেলেটার একটা গালে মেয়েটার হাত। ধীরে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। বেশ আবেগঘন মুহুর্ত। বোধহয় ওরা কিস করতে চলেছে। একসপ্তাহ আগেও ছেলেটার গালে মেয়েটার হাত পড়েছিল। তবে আজকের সাথে তার তুলনা চলেনা। সৌর মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিয়ারটা কি আজ একটু বেশিই তেতো লাগছে? মুখটা বিস্বাদ ঠেকছে কেন?  কয়েকদিন আগে কি একটা প্রসঙ্গে অফিসের বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড গৌরদা বলছিলেন, "বুঝলে সৌর, যুগ পাল্টাচ্ছে। সময়টা ভীষণ তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। পুরনো সবকিছু বেমানান হয়ে পড়ছে। একটা গোটা জেনারেশন নিজেদের শেষ করার জন্য কেমন উঠে পড়ে লেগেছে দেখছ তো?" সৌরর মনে পড়ে গেলো। ও উঠে পড়ল। আজ আর বিয়ার খাওয়া হবে না। পাব থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সৌরর চোখে পড়ল বিল কাউন্টারের এক পাশে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটাকে। একেই আগের দিন মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড বলে মনে হয়েছিল। সৌর আর দাঁড়ালো না। পাবের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ডিজে নতুন গান চালিয়েছে, 'ফলক তক চল সাথ মেরে, ফলক তক চল সাথ চল....'। নিজেকে হঠাৎই বড্ড বেমানান মনে হল সৌরর।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ -
সুমন কর্মকার
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:723 | likes:0 | share: 0 | comments:0

একটা গরিব লোক ছিল। গরিব মানে এক্কেবারে গরিব, যাকে বলে হতদরিদ্র। চাল-চুলো কিচ্ছু ছিল না। লোকটা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতো আর টুকটাক কাজ করত। এই কারও বাড়িতে মিস্ত্রী লেগেছে ও লেগে যেতো বালি চালা অথবা ইঁট বওয়ার কাজে, কারও অনুষ্ঠান বাড়ি হচ্ছে, ও লেগে যেতো পাত পরিষ্কার করতে, যখন কিছুই জুটতো না তখন শাসকদলের মিছিলে পা মেলাতো, সেদিনের মতো রাতের খাওয়া দাওয়া তো জুটতোই, স্থানীয় নেতার মন ভালো থাকলে থাকলে কখনো সখনো বিশ পঞ্চাশ টাকা নগদও মিলে যেতো। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো। গরিব লোকটার কোনো দুঃখ ছিল না। মনে করতো এই বেশ ভালো আছি।

তা একদিন ওই গরিবটা এরকমই একটা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে গেলো এক বিশাল সভায়। দেখলো চারদিকে লোকে লোকারণ্য, ওর পাড়া থেকেও বহু মানুষ এসেছে এবং কাতারে কাতারে এসেই চলেছে। কোন দূর দেশ থেকে নাকি বিশাল বড় মাপের এক নেত্রী এসেছেন হেলিকপ্টারে চড়ে। তারই বক্তব্য শোনানোর জন্য সব পাড়া থেকে লোক নিয়ে আসা হয়েছে। সেই সকাল থেকে জমায়েত শুরু হয়েছে। দুপুর নাগাদ ওকে নগদ দুশো টাকা দিয়ে দিলেই ও ফেরার পথ ধরবে। পাড়ার নেতার সাথে সেরকমই কথা হয়ে আছে। বড় নেতা, মাঝারি নেতা, ছোটো নেতার বক্তব্য শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গেলো। ভিড়ের মাঝে সেই পাড়ার নেতার দেখাও পাওয়া যাচ্ছেনা। এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। মঞ্চের সবাই চলে গেলে বিকেল নাগাদ দেখা মিললো নেতার। একগাল হেসে গরিবকে দুশোটা টাকা ধরিয়ে দিলো। ওর মতো আরও অনেকেই টাকা পাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। নেতা সবাইকে হেসে হেসে পয়সা দিতে থাকলো। গরিব টাকা নিয়ে ফেরার পথ ধরতেই যাচ্ছিলো। হঠাৎ দেখলো ওদেরই পাড়ার একটা বৌয়ের সাথে পাড়ার নেতাটার একটা ঝগড়ামতো হচ্ছে। বৌটাকে গরিবটা চেনে। গেল বছর ওর বরটা রেলে কাটা পড়েছে, এখন দু তিনটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে খায়। বৌটা এসেছে ওর তিনটে মেয়েকে নিয়ে। তার মধ্যে একটা আবার কোলে, সেটা সমানে কেঁদেই চলেছে। আর বাকিদুটো এতোই ধুঁকছে, মনে হচ্ছে এখনই মরে যাবে। বৌটার অবস্থাও তেমনই। নেতা বলছে দুশো টাকার বেশি এক পয়সা দিতে পারব না। আর বৌটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে চলেছে, না বাবু আমরা তো চারজন আছি। কম করে তিনশোটা টাকা দাও। আস্তে আস্তে নেতার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। এতোগুলো লোককে পয়সা দিতে হবে, পাড়ার ক্লাবে রাতের ফিস্টের সব আয়োজন করতে হবে। আজ আবার ছেলেগুলো বাংলা ছেড়ে ইংলিশ খাবার বায়না ধরেছে। তার মধ্যে আবার এই। কাঁহাতক সহ্য হয়? বৌটাও নাছোড়বান্দা। নাকি সুরে একই কথা বারবার বলে চলেছে। নেতা আর পারলো না। হাতটা খানিক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একবার ওপরে উঠে আবার নীচে নেমে এলো। সপাটে একটা চড়। বৌটা বাচ্চা সমেত ধপ করে পড়ে গেলো। বাকি দুটো মেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নেতা একটু মুচকি হেসে নোটের গোছা হাতে পরেরজনের দিকে এগিয়ে গেলো। The show must go on. 

কিন্তু না, শো টা চালু রইলো না। নেতা হঠাৎ মাথা চেপে বসে পড়লো। কোন ফাঁকে গরিবটা একগাছা ইঁট তুলে নেতার একেবারে ব্রম্ভতালুতে সজোরে বসিয়ে দিয়েছে। পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় আশেপাশের লোকজন খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারই মধ্যে নেতার চ্যালাদের একজন চিল চিৎকার করে উঠলো, 'মেরে ফেললো রে, পাগলাটা কেষ্টদাকে বোধহয় মেরেই ফেললো'। পুলিশ এলো। গরিবটা পালানোর চেষ্টা করলো না। পুলিশ টানতে টানতে ওকে জিপে তুললো। জিপে ওঠার থেকেই শুরু হলো অকথ্য মার। ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের নেতাকে 'attempt to murder' বলে কথা। খাঁকি নিজের প্রভুভক্তি প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করল না। চলল বুট, লাঠির যথেচ্ছ ব্যবহার। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেলে পুলিশগুলোর একজন বলে উঠলো, 'স্যার! একে খামোখা থানায় নিয়ে গিয়ে ফ্রির খাবার খাওয়ানোর কি মানে হয়? বলেন তো এখানেই ঠুকে দিই?' স্যারের কথাটা বেশ পছন্দ হলোনা। বললেন, 'আরে ধ্যাত! সারাজীবন রাজা উজির মেরে রিটায়ারমেন্টের আগে এসে কি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করব? নিয়ে চল থানায়। রাতে পার্টির লোকজন এলে ওদের হাতেই তুলে দেবো। ওরাই যা পারে করুকগে যাক।' তাই হলো। রাতের অপেক্ষায় গরিবটা আধমরা অবস্থায় গারদে পড়ে রইলো। সন্ধ্যে পেরিয়ে একসময় রাত হলো। পার্টির লোকও এলো। বিলিতি মদের গন্ধে থানাটা ম ম করতে লাগলো। গারদ থেকে টেনে হিঁচড়ে গরিবটাকে বের করে নিয়ে আসা হলো। থানা থেকে বেরিয়ে সোজা যাওয়া হবে নেতার ফার্ম হাউসে। সেখানেই গরিবটাকে খালাস করা হবে। শালার বড্ড বাড় বেড়েছে। কিন্তু এ কি! এতো আওয়াজ কিসের? এতো আলোই বা আসছে কোথা থেকে? একটা হাবিলদার স্যান্ডো গেঞ্জি পরে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিলো, 'হুজুর লাল পার্টির লোক এসেছে। হাতে মশাল নিয়ে থানা ঘেরাও করে বসে আছে। বলছে ওরা নাকি গরিবটার নিঃশর্ত মুক্তি চায়।' গরিবটা মেঝেতে পড়ে পড়ে এসব শুনে অবাক হয়ে গেলো। ওকে বাঁচাতে এত্তো লোক এসেছে? এরা কারা? শুনতে শুনতে একসময় ও পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়লো। যেটুকু চেতনা ছিল তাতেই বুঝত পারলো পুলিশগুলো ওকে বের করে নিয়ে আসছে। চারদিক থেকে গগনভেদী কান ফাটানো আওয়াজ আসছে, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ'। পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে ও দেখলো কয়েকজন ওর মতোই হতদরিদ্র মানুষ ওকে বুকে জাপটে জড়িয়ে ধরছে আর বলে চলেছে কয়েকটা অদ্ভুত শব্দ। 'লাল সেলাম, কমরেড'।

গল্প নয় সত্যি -
সুমন কর্মকার
Nov. 20, 2024 | গল্প | views:101 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আজ একটা ঘটনা শুনলাম। সাদামাটা হলেও 'রসালো' বটে। ভাবলাম আপনাদেরও শোনাই। এই বাদলা রাতে জমবে ভালো। 

আমাদের জেলারই আশেপাশের এক গ্রামের ঘটনা। একটা বৌ ছিল। একদম সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ। বরটা কোনো এক সরকারি দফতরে  চুক্তিভিত্তিক ঠিকে কেরানীগিরির কাজ করতো। শ্বশুর শাশুড়ি বিয়ের কয়েক বছর আগেই গত হয়েছিলেন। তাই স্বামী স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে তিনজনের ছোট্ট সংসার। তো একদিন হল কি, বলা নেই, কওয়া নেই  শ্বশুর বাড়ি থেকে সপরিবারে ফেরার পথে বৌ আর আঠেরো বছরের ছেলেকে ফেলে রেখে বরটা হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে মারা গেল। হঠাৎ মানে হঠাৎই। হাসপাতাল অবধি নিয়ে যেতেও হলো না। জ্বর জ্বালা নেই, কষ্ট পাওয়া নেই, একদম শান্তির মরণ। 

তো বরটা শান্তিতে পটল তুললেও বৌ আর ছেলেটা কিন্তু খুব একটা শান্তিতে থাকতে পারল না। কন্ট্র‍্যাকচুয়েল কাজের বেতন তো আপনারা জানেনই। রোজকার সংসার খরচ আর ছেলের পড়াশুনো চালাতেই বেশিরভাগটা বেরিয়ে যেতো। যেটুকু জমানো ছিল তাতে মাস খানেকের বেশি চালানো সম্ভব ছিলনা। তাই অন্যকোনো উপায় না দেখে বিধবা বৌটা ছেলেকে নিয়ে চলল মৃত স্বামীর অফিসে। অফিসে ঢোকামাত্রই সহানুভূতির বন্যা বয়ে গেল। 'আপনার হাজব্যান্ড দারুণ কাজের মানুষ ছিলেন', 'অমুক দাকে আমরা কক্ষণো ভুলতে পারব না' এসব আর কি। কিন্তু যেই না বৌটা বলল মৃত স্বামীর জায়গায় ছেলেকে যদি কোনোভাবে কাজে রাখা যায়, সবার ভীষণ তাড়া পড়ে গেল। 'আজ না আমার টেবিলে অনেকগুলো ফাইল পড়ে গেছে। কাজের ভীষণ চাপ। আপনি বরং অমুক বাবুর কাছে যান। উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন' বলে বাবুরা একে একে নিজেদের গা বাঁচিয়ে সটকে পড়তে লাগলেন। আপনারা আবার বাবুদের জাজ করবেন না যেন। আজকের বাজারে কেই বা এসব উটকো ঝামেলা যেচে মাথায় নিতে চায় বলুন তো? আপনি নিজেই নিতেন কি? যাই হোক, অমুকবাবু তমুকবাবু্র টেবিল ঘুরে বৌটা শেষ অবধি পৌঁছালো বড়বাবুর কেবিনে। দেখা গেলো বড়বাবু মানুষটা কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের। পরিচয় পাওয়া মাত্র প্রাক্তন সহকর্মীর স্ত্রীকে যথোচিত খাতির করে বসালেন এবং সব শুনে একটা তারিখ দিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতে বললেন। উনি আগে থেকেই অফিসারকে সবটা বলে রাখবেন। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। বৌটা একরাশ আশা নিয়ে দেবতুল্য মানুষটার মঙ্গল কামনা করতে করতে উজ্জ্বল মুখে বাড়ি ফিরে এলো। নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে নিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করতেও গেল। বড়বাবু সত্যিই এক কথার মানুষ। অফিসার দেখামাত্র সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। ছেলের কাজ হয়ে গেল। মা খুশি, ছেলেও খুশি। কিন্তু বৌটার কপালে সুখ মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার নয়। একদিন বিকেলবেলা, ছেলে তখনও অফিস থেকে ফেরেনি, 'দেবতুল্য' বড়বাবুর পেয়ারের আর্দালি এসে পান চিবোতে চিবোতে বৌটাকে বলল, 'বড়বাবু আজ সন্ধ্যের দিকে আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। ওই সাতটা নাগাদ গেলেই হবে।' ব্যপারটা প্রথমে বোধগম্য না হলেও আর্দালি যখন বেরোতে বেরোতে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হেসে বলল, 'বৌদি বাপেরবাড়ি গেছেন তো তাই আর কি...' বৌটার বুঝতে কিছুই বাকি রইলো না। হতবাক হয়ে আর্দালির চলে যাওয়া দেখতে কখন যে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল বুঝতেই পারল না। যথাসময়ে ছেলে ফিরে এলো। ছেলেকে খেতে দিতে দিতে বৌ টা বলল, 'বাবু, তুই বরং একটা অন্য কাজ দ্যাখ। এটা বোধহয় আর থাকবে না।' মায়ের কথা শুনে ছেলে যতোটা না আশ্চর্য হল, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হল যখন দেখল পরেরদিনই মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়ে একটা সামান্য ভুলের জন্য বড়বাবু দারুণ অপমান করে সত্যিই অফিস থেকে তাড়িয়ে দিলেন।' 

কাজ্টা চলে যাওয়ার পর মা-ব্যাটা পড়ল অকুল পাথারে। ঘোর বর্ষাকাল। বাড়ির টালি ফেটে ঝরঝর করে জল পড়ছে।  থালা বাটিগুলো পাতার সাথে সাথে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। ছেলের এই মাসের বেতন  ঢুকলে মিস্ত্রী লাগানোর কথা। মিস্ত্রীকে বলাও আছে সেরকম। কিন্তু সব কেমন ভেস্তে গেল। বর্ষাটাও আগেভাগে চলে এলো, চাকরিটাও আর রইলো না। যাই হোক, সারা রাত ধরে জল বাঁচিয়ে বিছানা পত্তর এদিক ওদিক করে সকাল হতেই ত্রিপল যোগাড় করতে পঞ্চায়েত অফিস ছুটলো বৌটা। প্রধান নেই। অফিসে ঢুকে ত্রিপলের কথা বলামাত্র উপপ্রধান জানালেন 'ত্রিপল শেষ। পরের লট আসলে খোঁজ নিয়ে যাবে।' পরের লট কবে আসবে জিজ্ঞেস করাতে ব্যস্ত উপপ্রধান কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে জানালেন তার জানা নেই। অফিস থেকে বেরোতেই প্রধানের এক চ্যালা 'ও বৌদি ও বৌদি' বলে দাঁড় করিয়ে বৌটাকে আগাপাশতলা মেপে নিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল, 'আরে, যাচ্ছেন কোথায়? আপনাদের বাড়ি তো আমি দেখেছি। আজ রাতে বৃষ্টি এলে একদম ভেসে যাবেন। ত্রিপল তো লাগবেই।' তারপর গলাটা অল্প নামিয়ে বলল, 'আসলে জানেনই তো আমাদের উপপ্রধানের এখনও বিয়ে হয়নি। ঘর সংসার নেই। রক্ত গরম। তাই মাঝে মাঝে মেজাজটা একটু খিঁচড়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন একেবারে মাটির মানুষ।' চ্যালার লোলুপ চাওনিই বলে দিচ্ছিল আলোচনাটা আস্তে আস্তে কোন দিকে যাচ্ছে। এরপর ছেলেটা যখন ভুরু নাচিয়ে সরাসরি বলল, 'শুধু ত্রিপল কেন? দাদাকে খুশি করে দিতে পারলে আরও অনেককিছুই পাবেন’ তখন ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। নিজের ছেলের বয়সী একজনের কাছে এহেন 'দারুণ' প্রস্তাব পেয়ে বৌটার চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠলো। উদভ্রান্তের মতো অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ছেলেটা তখনও চিৎকার করে বলে চলেছে 'ও বৌদি রাগ করলেন নাকি? শরীর তো আর বয়স মানেনা বুঝলেন কিনা'। বৌটা বাড়ির পথ ধরলো।

গল্প হলে এটা এখানেই শেষ হয়ে যেতো। আপনারাও পটাপট হাততালি দিতেন। বলতেন এই তো চাই। একটা সৎ মানুষের আপোষহীন লড়াইয়ের গল্প। দারুণ ব্যাপার। কিন্তু আমি নিরুপায়। এটা তো গল্প নয়, ঘটনা। তাই শেষটা এভাবে হলো না। আজকের মতোই কোনো এক বৃষ্টিভেজা রাতে পাড়ার মাতব্বররা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে গ্রামের উপপ্রধানের বাড়ি থেকে আলুথালু বেশে বৌটাকে বেরিয়ে আসতে দেখলেন। তাদের বিশেষ কিছু বলার ছিল না। কারণ পঞ্চায়েত অফিস থেকে বেরিয়ে বৌটা যখন উপপ্রধানের 'ইন্টারেস্টিং' প্রস্তাবের কথা এনাদের জানিয়েছিল, এনারা ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'কি জানি বাপু! গ্রামে তো তুমিই একা মেয়েমানুষ নও। তোমার চাইতে ঢের বেশি দেখতে শুনতে ভালো আরও অনেকেই আছে। কই তাদের তো কখনও এমন বলতে শুনিনি। দেখে দেখে তোমাকেই তার মনে ধরল?' 

আজ বৌটার বাড়ির পাকা ছাদ। ছেলেটাও শুনলাম পঞ্চায়েতেই কি একটা কাজ করছে। দুহাতে কামাচ্ছে। আজ আর ওদের কোনো অসুবিধে নেই। কে বলে মন দিয়ে পূজো করলে 'ভগবান' সন্তুষ্ট হন না? শুধু সঠিক মন্ত্রটা জেনে নিতে হবে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933